ঐতিহাসিক এনসাইক্লোপিডিয়া

চীন এর গৃহযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট ব্যবস্থা

চীন এর গৃহযুদ্ধ (১৯৪৫–১৯৪৯) দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যা কমিউনিস্ট শাসনের সৃষ্টি এবং চীনা সমাজ ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল। এই প্রবন্ধে সংঘাতের কারণ, মূল ঘটনা, পরিণতি এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) এর গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সংঘাতের পটভূমি

চীন এর গৃহযুদ্ধ ২০ শতকের প্রথমার্ধে দেশে বিদ্যমান গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধের ফলস্বরূপ। ১৯১১ সালে চিং রাজবংশের পতনের পর চীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিচ্ছিন্নতায় পড়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যার মধ্যে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল।

সিপিসি শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকার রক্ষায় সক্রিয়ভাবে লড়াই করে, মৌলিক সংস্কার এবং সমাজে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছিল। অন্যদিকে, চাং কাইশির নেতৃত্বে গোমিনদানের জাতীয় ঐক্য恢复 এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা ছিল, যাদের তারা জাতীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি মনে করত।

গৃহযুদ্ধের পর্যায়সমূহ

প্রথম পর্যায় (১৯৪৫–১৯৪৬)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন জাপান পরাজিত হয়, গোমিনদান এবং সিপিসি দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই শুরু করে। ১৯৪৫ সালে চুংকিংয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সমঝোতার চেষ্টা করে। কিন্তু আলোচনাগুলি সফল হয়নি, এবং ১৯৪৬ সালে খোলামেলা যুদ্ধে প্রবেশ ঘটে।

যুদ্ধের প্রথম পর্যায় গোমিনদান এবং সিপিসি উভয়ের জন্য সফলতার বৈশিষ্ট্য ছিল। গোমিনদান নানকিং এবং সাংহাইয়ের মতো বড় শহরগুলো নিয়ন্ত্রিত করেছিল, যখন সিপিসি কৃষি অঞ্চলে কাজ করছিল, কৃষকদের মধ্যে সমর্থন তৈরির চেষ্টা করছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৪৭–১৯৪৯)

১৯৪৭ সাল থেকে, গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয়, আরো সিদ্ধান্তমূলক পর্যায় শুরু হয়। কৃষকদের সমর্থন নিয়ে কমিউনিস্টরা গোমিনদানের বিরুদ্ধে সফল অপারেশন পরিচালনা শুরু করে। গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে পার্টিজান ট্যাকটিক্স ব্যবহার করে এবং কৃষকদেরকে সংগ্রামে জড়িত করে সিপিসি তাদের অঞ্চল ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়।

এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলির মধ্যে লাওশান এবং হাইলানশান যুদ্ধে কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য বিজয় ঘটে। ১৯৪৯ সালে, বেইজিং দখলের পর, গোমিনদান তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য হয়, যা গৃহযুদ্ধের কার্যত সমাপ্তি ঘটে।

কমিউনিস্ট ব্যবস্থা গঠন

১ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না ঘোষণা করা হয়, এবং মাও জেডং তার প্রথম সভাপতি হন। কমিউনিস্ট শাসনের সৃষ্টি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করে। নতুন শাসন মার্ক্সবাদী মতাদর্শ ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ছিল।

রাজনৈতিক সংস্কার

কমিউনিস্ট সরকার ফিউডাল অবশিষ্টাংশ এবং শ্রেণী বৈষম্য নির্বীকারের লক্ষ্য নিয়ে মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার চালনা শুরু করে। গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিল কৃষি সংস্কার, যার মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে জমি পুনর্বণ্টন করা হয়। এটিকে জমিদার এবং ধনী কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, যা দমন এবং সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থনৈতিক পরিবর্তন

কমিউনিস্ট পার্টি পরিকল্পিত অর্থনীতি চালুর মাধ্যমে উৎপাদন এবং বিতরণের সব দিক নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে জনগণের কমিউনগুলোর গঠন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল, যেখানে কৃষকদের কমন জমিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তবে এই ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে ওঠে এবং ১৯৬১ সালে আংশিকভাবে বাতিল হয়।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব

১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে, যা মাও জেডংয়ের উদ্যোগে হয়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সমাজে "বিপ্লবী" উপাদানগুলি নির্মূল করা এবং সিপিসির ক্ষমতা শক্তিশালী করা। গণ রেপ্রেশন, বুদ্ধিজীবীদের শিকার এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ধ্বংস এই সময়ের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব অর্থনৈতিক পতন এবং সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু এই যুগের সমাপ্তির পর নতুন সংস্কার ও উন্মুক্ততার এক নতুন তরঙ্গ শুরু হয়।

গৃহযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট ব্যবস্থার উত্তরাধিকার

গৃহযুদ্ধ এবং পরবর্তী কমিউনিস্ট ব্যবস্থা চীন এবং এর সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর উদ্ভব এবং সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন দেশের উন্নয়নের জন্য অনন্য অবস্থার সৃষ্টি করে। তবে কঠোর দমন এবং মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন জনগণের মনে অব্যাহত প্রভাব ফেলে।

আধুনিক চীন, বিশৃঙ্খলার সময় পরে স্বাভাবিকভাবে উঠে দাঁড়ায়, বিশ্ব মঞ্চে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। তবে রাজনৈতিক অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা এবং ঐতিহাসিক স্মৃতি সম্পর্কে চলতে থাকা বিতর্ক প্রমাণ করে যে গৃহযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট ব্যবস্থার উত্তরাধিকার এখনও প্রাসঙ্গিক।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

কমিউনিস্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর, চীন আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি সক্রিয় খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। দেশটি অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে এবং বিশেষ করে ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে দেং শিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে চীন খোলার পর পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।

কমিউনিস্ট ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সমালোচনার বিষয়ও হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে টিয়েনঅ্যানমেন স্কোয়ার-এ গণতন্ত্রের জন্য গণ প্রতিবাদের সময়, যখন সরকার দ্বারা দমন ঘটে।

উপসংহার

চীন এর গৃহযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট শাসনের উত্থান একটি জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া, যা দেশের উন্নয়নে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই সময়ের অধ্যয়ন আধুনিক চীন, এর অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত চ্যালেঞ্জগুলি বোঝার এবং সমাজের বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত পৌঁছানোর পথগুলি বোঝাতে সহায়ক।

গৃহযুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট ব্যবস্থার উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ অব্যাহত রয়েছে, ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিকবিদ এবং সমাজশাস্ত্রবিদদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে যায়। এই সময়ের চীনের ইতিহাস জটিল, কিন্তু এর পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের একটি অপরিহার্য অংশ।

শেয়ার করতে:

Facebook Twitter LinkedIn WhatsApp Telegram Reddit email

অন্য নিবন্ধগুলি: