ঐতিহাসিক এনসাইক্লোপিডিয়া
নেপালের সরকারী ব্যবস্থার বিকাশ একটি অনন্য ইতিহাস, যা দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় জুড়ে। প্রথম মৌলিক রাজতন্ত্র গঠনের সময় থেকে বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্র পর্যন্ত, নেপাল বহু রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে প্রতিটি স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, জাতীয় পরিচয় বজায় রাখা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটায়। এই নিবন্ধে নেপালের সরকারী ব্যবস্থার বিকাশের মূল পর্যায় আলোচনা করা হয়েছে।
নেপাল ভূখণ্ডে প্রথম সরকারী গঠন ছিল লিচ্ছভি রাজ্য, যা খ্রিস্টাব্দ ১ থেকে ৯ শতক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। লিচ্ছভিরা কাঠমান্ডুর উপত্যকায় প্রথম কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাদের শাসন নেপালকে একটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক একক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়ে নেপালী রাজতন্ত্রের ভিত্তিগুলি বিকশিত হয়েছিল, প্রথম প্রশাসনিক বিধিগুলি স্থাপন করা হয়েছিল এবং দেশ ভারত এবং তিব্বতের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ শুরু করেছিল।
লিচ্ছভি রাজ্যগুলি তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক শাসন পরিচালনা করত। শাসকরা প্রায়ই স্থানীয় এলিট এবং কর্মকর্তাদের পরামর্শের কাছে যেতেন এবং ধর্মীয় নেতা ও সন্ন্যাসীদের সমর্থন উপভোগ করতেন। এটি নির্বাচনী এবং পরামর্শমূলক ব্যবহারিক শাস্ত্রের প্রথম উপাদানগুলির প্রতি ইঙ্গিত করে, যা পরবর্তীতে নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
১২ থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত নেপালে একটি নতুন রাজবংশ মল্ল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা সরকারের বিকাশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। এই সময় নেপাল কয়েকটি ছোট রাজ্যগুলিতে বিভক্ত হয়েছিল, প্রত্যেকটি মল্ল রাজবংশের একটি ডালের অধীনে ছিল। কাঠমান্ডু, ভক্তপুর এবং পতন জাতীয় রাজ্যগুলি তাদের স্বাধীনতা অনেকটাই বজায় রেখেছিল, যদিও তাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ ঘটেছিল।
এছাড়াও মল্ল রাজবংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য রেখে গেছে যা স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অর্জনের আকারে। এই সময়ে অনেক বিখ্যাত মন্দির এবং প্যালেস নির্মিত হয়েছিল, যা আজও নেপালী ঐতিহ্যের প্রতীক। রাজনৈতিক ভঙ্গুরতা সত্ত্বেও, মল্ল সরকারী প্রতিষ্ঠানকে সুদৃঢ় করতে, স্থানীয় প্রশাসনের পদ্ধতি এবং সামাজিক কাঠামো উদ্ভাবনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল।
১৮ শতকে নেপালের রাজনৈতিক জীবনে একটি নতুন যুগ শুরু হয়, যখন রাজা প্রশান্ত সিং শাহ বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে একটি দেশ গঠন করেন। শাহ রাজবংশের শাসনের সূচনা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং বিশেষভাবে মুখ্যমন্ত্রী রাজতন্ত্র স্থাপনের একটি যুগ শুরু করে। ১৭৬৮ সালে প্রশান্ত সিং শাহ স্থানীয় শাসকদের পরাজিত করে নেপালকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
শাহ রাজবংশ আবসোলিউটিস্ট রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি প্রতীকী ছিল, যেখানে রাজা ছিল সর্বোচ্চ শাসক, যার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। তবে এ সময় ছিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার এবং কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক নির্দেশনা উন্নয়নের সময়। শাহ রাজবংশ তাদের শক্তি শক্তিশালী করতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে চেয়েছিল, এবং ভারত ও তিব্বতের সাথে নেপালের সম্পর্ককে দৃঢ় করার জন্য তারা কূটনৈতিক চ্যানেলগুলি সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করেছিল।
নেপাল কখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরকারিভাবে উপনিবেশ ছিল না, তবে ১৯ শতকে দেশটি ব্রিটেনের শক্তিশালী প্রভাবের অধীনে চলে আসে। এই সময়ে নেপাল ব্রিটিশ ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠে, এবং ব্রিটিশরা তার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। যদিও নেপাল তার স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল, ব্রিটেন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল, এটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করে।
বহিরাগত সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেপালও তার সেনাবাহিনী এবং সরকারী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাপন গঠন করতে শুরু করে, যা আধুনিক সরকারী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫০ সালে নেপাল এবং ব্রিটেনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা নেপালের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তবে এটি দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, নেপাল তার সরকারী ব্যবস্থায় একটি সিরিজ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। ১৯৫১ সালে দেশে একটি বিপ্লব ঘটে, যার ফলে আবসোলিউটিস্ট রাজতন্ত্রকে উৎখাত করা হয় এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির ছিল এবং কয়েক বছর পর আবার রাজতন্ত্র পুনর্স্থাপন করা হয়, তবে এখন এটি সাংবিধানিক হয়। ১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে বহু দলীয় গণতন্ত্র থেকে পুরোপুরি বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন।
এই সিদ্ধান্তটি দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটি সময়সীমা সৃষ্টি করে, যা ১৯৮০-এর শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৯৯০ সালে নেপালে ব্যাপক প্রতিবনার ঘটনা ঘটে, যা জনগণের বিপ্লব নামে পরিচিত, যার ফলে বহু দলীয় ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার ঘটে এবং রাজা একটি সংবিধান গ্রহণ করতে বাধ্য হন, যা সংসদকে আরও ক্ষমতা প্রদান করে।
১৯৯০-এর দশকে নেপাল একটি গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়, যা গৃহযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এই সংঘাত, রাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত হয়েছিল। যুদ্ধের সময়, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদীরা) বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরোধিতা করে, জনগণের জন্য আরও ক্ষমতা দাবি করত।
গৃহযুদ্ধ ২০০৬ সালে শেষ হয়, যখন মাওবাদীরা শান্তি আলোচনা মেনে নেয় এবং ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। এভাবে, নেপাল একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংসদীয় দিকে সংস্কার করা হয়। ২০১৫ সালে নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয় এবং নেপাল একটি বহু দলীয় ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
আজ নেপাল একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান। নেপালের সংবিধান, যার গ্রহণ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, ক্ষমতার পৃথকীকরণ, বাক্য স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং আইনের সমতার নিশ্চয়তা দেয়। অর্জনের অনেক সত্ত্বেও, দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মতো একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
শেষ কয়েক বছরে নেপালে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বেড়েছে এবং যদিও দেশটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, শাসন ব্যবস্থা একটি ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। নেপালের সংসদ প্রধান ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়, এবং এটি সমাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
নেপালের সরকারী ব্যবস্থার বিকাশ হাজার বছরেরও বেশি সময় নিয়ে এবং বহু রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, প্রতিটি পরিবর্তন দেশের আধুনিক শক্তির কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন রাজ্যগুলো থেকে শুরু করে স্বৈরশাসন এবং প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বহু দলীয় গণতন্ত্র, নেপাল একাধিক পর্যায় অতিক্রম করেছে, যাতে এটি একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সকল চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার মধ্যেও, দেশটি আরও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে।