সিরিয়া, আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে, একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে, যা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দিক অন্তর্ভুক্ত করে। সিরিয়ার স্বাধীনতা তার ইতিহাসে একটি মূল মুহূর্ত, যেহেতু এই প্রক্রিয়াটি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদেশী শাসনের অবসান ঘটায় এবং দেশের বিকাশে একটি নতুন যুগের সূচনা করে। স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়াটি সিরিয়ার জাতীয় পরিচয় এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, সিরিয়া ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯২০ সালে লিগ অফ নেশনস ফ্রান্সকে সিরিয়া এবং লেবাননের পরিচালনার জন্য একটি ম্যান্ডেট প্রদান করে। এই সময়টি দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সময় ছিল, যা প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা প্রায়ই স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি প্রশাসন কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত এককে দেশটিকে ভাগ করার চেষ্টা করছিল, যা শুধুমাত্র সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে বাড়িয়ে তুলছিল।
বাড়তে থাকা অসন্তোষের মাঝে ১৯২৫-১৯২৭ সালে দেশে বৃহত্তম সিরিয়ান বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহটি ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক প্রতিবাদ ছিল, যেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিদ্রোহের দমন সত্ত্বেও, এটি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠেছিল, যা কলোনিয়াল শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিরিয়ার মানুষদের দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।
১৯৩০-এর দশকে সিরিয়ায় বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন গঠিত হতে শুরু করে, যা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠীগুলির একটি হলো সিরিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট, যা আরব দেশের একতায় এবং বিদেশী নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছিল। এই আন্দোলনগুলি রাজনৈতিক প্রচারকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করেছিল, মিটিং এবং গণঅনশন সংগঠিত করেছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি সিরিয়ার জনগণের সমস্যাগুলির প্রতি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে ১৯৪০ সালে সিরিয়ার ভূখণ্ডে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে প্রভাবের জন্য সংগ্রাম শুরু হয়। নাজিদের দখলাধীন ফ্রান্স তার অঞ্চলে অবস্থান দুর্বল করে, যা জাতীয় আন্দোলনের উন্নয়নের জন্য সহায়ক ছিল। ইংরেজ বাহিনীর প্রবেশের পর পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়, যারা ফরাসি সহযোগীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা সিরিয়ার মানুষদের স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে সিরিয়ায় বাড়তে থাকা অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায়, যা ব্যাপক প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৬ সালে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বাড়তে থাকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাপে, ফরাসি কর্তৃপক্ষ দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৪৬ তারিখটি সিরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভের তারিখ হয়ে ওঠে, এবং এই দিনটি এখন জাতীয় ছুটি হিসেবে পালিত হয়।
সিরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, তবে অনেক সমস্যা সমাধান করা বাকি ছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির থেকেই যায় এবং দ্রুত একের পর এক বিপ্লব এবং সংঘাত শুরু হয়, যা পূর্ণাঙ্গ সরকারের প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। তবুও, স্বাধীনতা সিরিয়ার মানুষকে তাদের জাতীয় পরিচয় গঠন করতে এবং নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে সুযোগ দেয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর সিরিয়া অনেক অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠী উদীয়মান হয়, প্রতিটি তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং লক্ষ্য নিয়ে। ১৯৪৯ সালে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগের সূচনা করে। দেশে অসন্তোষ ও অবিশ্বাসের পরিবেশ বিরাজ করছিল, যা পরবর্তীতে স্বৈরাচারী শাসন এবং সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটায়।
সিরিয়া ইসরায়েলের সাথে সংঘাতের মুখোমুখি হয়, যা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ফলে সৃষ্টি হয়। এই সংঘাতটি সিরিয়ার বিদেশনীতি তথা বছরের পর বছর ধরে একটি প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে এবং শাসনে স্বৈরাচারী প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
সিরিয়ার স্বাধীনতা ১৯৪৬ সালে আত্ম-নির্ধারণ এবং জাতীয় পরিচয় বিকাশের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। তবে এই প্রক্রিয়া মুক্তির সাথে শেষ হয়নি, এবং দেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যা পরবর্তী দশকগুলোর জন্য এর ভবিষ্যৎকে নির্ধারিত করেছে। সিরিয়ার স্বাধীনতা দেশের ইতিহাসে একটি গভীর ছাপ ফেলেছে এবং এটি আধুনিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রক্রিয়াগুলিতে প্রভাব ফেলছে।