ঐতিহাসিক এনসাইক্লোপিডিয়া

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন

যুদ্ধের অংশগ্রহণ কীভাবে ভারতীয় সমাজ এবং এর রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল

ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্রে প্রভাব ফেলেছিল, যার মধ্যে ভারতও ছিল, যা সেসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। যুদ্ধটি ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি জাতীয়তাবাদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল এবং দেশটির স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াগুলিকে ত্বরান্বিত করেছিল। এই নিবন্ধে আমরা ভারতের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অংশগ্রহণ এবং এর ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের উপর প্রভাবগুলি বিশ্লেষণ করবো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ

যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ১৯১৪ সালে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, তখন ভারত স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংঘর্ষের অংশ হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিভিন্ন ফ্রন্টে পাঠানো হয়েছিল, যার মধ্যে:

  • পশ্চিম ফ্রন্ট: ভারতীয় সেনাবাহিনী ফ্রান্স এবং ফ্ল্যান্ডারসে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ এবং ফরাসি সৈন্যদের সাথে লড়েছিল।
  • মধ্যপ্রাচ্য: ভারতীয় বাহিনীও অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, মেসোপোটামিয়া ও প্যালেস্টাইনে অভিযান পরিচালনা করে।
  • আফ্রিকা: কিছু ভারতীয় দলকে পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান বসতবাড়ির সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল।

ভারত ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি সৈন্য প্রদানের পাশাপাশি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে সমর্থনের জন্য উল্লেখযোগ্য সম্পদ ও অর্থ সরবরাহ করেছিল। তবে যুদ্ধের সময়কাল এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, ভারতের জনমত পরিবর্তিত হতে শুরু করে।

যুদ্ধের ফলাফল ভারতের জন্য

যদিও ভারত যুদ্ধের সময়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তবুও এর অংশগ্রহণ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল নিয়ে এসেছে:

  • অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি: যুদ্ধটি কর বৃদ্ধি এবং পণ্যের দাম বাড়ানোর ফলে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে তীব্র করেছে। এর ফলে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়।
  • রাজনৈতিক কার্যকলাপ: বেড়ে ওঠা জাতীয় আত্মসচেতনতা রাজনৈতিক কার্যকলাপকে বাড়িয়ে তুলেছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সহ নতুন জাতীয়তাবাদী সংগঠন ও গোষ্ঠী উপস্থিত হয়েছে।
  • ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়া: বেড়ে ওঠা অসন্তোষের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ব্রিটিশ সরকার সংস্কার প্রস্তাব করেছিল, যেমন ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেল্মসফোর্ড আইন, যা ভারতীয় প্রদেশগুলির জন্য কিছু স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল, তবে অনেক ভারতীয়র দাবির প্রতি এটি সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

জাতীয়তাবাদের বৃদ্ধি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় সমাজের উপর প্রভাবকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। যুদ্ধটি একটি শক্তিশালী জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি গঠনে সহায়তা করেছে এবং ভারতীয়দের তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ইচ্ছাকে গভীর করেছে। এই সময়ে সক্রিয়ভাবে বিকশিত হয়েছে:

  • স্বরাজ: স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার ধারণা, যা বিভিন্ন জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল।
  • সত্যাগ্রহ: মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক প্রস্তাবিত অহিংস প্রতিরোধের কৌশল, যিনি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন।
  • বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঐক্য: যুদ্ধটি বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীকে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে একত্রিত করতে সহায়তা করেছে, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর ঐক্যের সৃষ্টি করেছে।

নির্যাতন ও প্রতিক্রিয়া

যুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে ভারতীয় জনসাধারণের অসন্তোষ অব্যাহত ছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, যা আরও বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল:

  • ডেলি ক্যাম্প: ১৯১৯ সালে অমৃতসরে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে, যেখানে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিরস্ত্র ভারতীয় জনতার উপর গুলি চালায়, যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে একটি মোড়ের মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
  • নতুন আইন: ব্রিটিশ সরকার সভা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করেছিল, যা ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ধর্মঘটের দিকে নিয়ে যায়।
  • জনসাধারণের আন্দোলন: জাতীয়তাবাদীরা স্বাধীনতা এবং ভারতীয়দের অধিকার দাবি করে জনসাধারণের আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করেন।

উপসংহার

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদক হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যুদ্ধের কারণে কঠিন পরিস্থিতি এবং ব্রিটিশদের নির্যাতনের ফলস্বরূপ অসন্তোষ একটি একক জাতীয় আন্দোলনের রূপ নিতে সাহায্য করেছে, যা অবশেষে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত হয়।

এইভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অনুগামী ফলাফলগুলি ভারতীয় সমাজে দশক জুড়ে অনুভূত হয়েছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং ভারতীয় জনগণের ঐক্যের শক্তিকে মুক্তির জন্য আকাঙ্ক্ষায় প্রদর্শন করেছিল।

শেয়ার করতে:

Facebook Twitter LinkedIn WhatsApp Telegram Reddit email

অন্য নিবন্ধগুলি: