ঐতিহাসিক এনসাইক্লোপিডিয়া

মার্গারেট থ্যাচার: জীবন ইতিহাস এবং ঐতিহ্য

মার্গারেট থ্যাচার (১৯২৫-২০১৩) — ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেত্রী, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের, যিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। তাঁর নীতি এবং পরিচালনার শৈলী যুক্তরাজ্য এবং বিশ্বের ইতিহাসে অমলিন ছাপ রেখেছে। এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর জীবন, কর্মজীবন এবং ঐতিহ্য পর্যালোচনা করব।

প্রাথমিক জীবন

মার্গারেট হিল্ডা রবার্টস ১৯২৫ সালের ১৩ অক্টোবর গ্র্যান্টেমে, লিঙ্কনশায়ার কাউন্টিতে, একটি মুদির দোকানের মালিক এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি দৃঢ় চরিত্র এবং উচ্চাভিলাষীতা প্রদর্শন করেছেন। মার্গারেটের শিক্ষা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়, পরে তিনি গ্র্যান্টেমের গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তিনি অধ্যয়নে চমৎকার দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন।

১৯৪৩ সালে থ্যাচার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যেখানে তিনি রসায়ন পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র জীবন এবং অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতিত্বে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পড়াশোনা শেষ করার পর, মার্গারেট একটি গবেষণাগারে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু তিনি দ্রুত বুঝতে পারেন যে তাঁর প্রকৃত vocation — রাজনীতি।

রাজনৈতিক কর্মজীবনের শুরু

১৯৫০ সালে থ্যাচার প্রথমবারের মতো কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে পার্লামেন্টে নির্বাচন দেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। তিনি হাল ছাড়েননি এবং ১৯৫৯ সালে ফিঞ্চি আসনের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সংসদে তিনি দ্রুত একজন সক্ষম বক্তা হিসেবে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলেন এবং দলের নেতৃত্বের দৃষ্টিগোচর করেন।

১৯৭০ সালে থ্যাচার এডওয়ার্ড হিথের সরকারের শিক্ষা এবং বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। এই পদে তিনি কয়েকটি অপ্রিয় সংস্কারের কার্যকরী করেন, যার মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে দুধের ব্যবস্থা বন্ধ করা অন্তর্ভুক্ত, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর 'দুধের থ্যাচার' উপাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, তাঁর দৃঢ়তা এবং জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা পার্টির অগ্রগতিতে তাঁর উত্থানে সহায়তা করে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী

১৯৭৫ সালে মার্কারেট থ্যাচার কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হন, তিনিই প্রথম নারী হিসেবে এই পদে আসীন হন। ১৯৭৯ সালে, অর্থনৈতিক সংকট ও উচ্চ বেকারত্বের প্রেক্ষাপটে, তিনি তাঁর দলের নির্বাচনী জয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। সরকারে আসার ফলে 'থ্যাচারাইজেশন'-এর সূচনা হয় — অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং জাতীয় গর্বকে দৃঢ় করার লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের একটি সূচি।

থ্যাচার মুক্ত বাজারনীতি প্রবর্তন করেন, রাষ্ট্রীয় খরচ কমাতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণ এবং ঐক্যের ক্ষমতা কমিয়ে আনার কাজে ব্যবস্থা নেন। এসব পদক্ষেপ কিছু সমর্থনের পাশাপাশি সমালোচনারও জন্ম দেয়, তবে এটি ১৯৮০-র দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট তৈরি করে। তিনি তাঁর কঠোর বিদেশী নীতির জন্যও পরিচিত হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সহায়ক হয়।

ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সফলতা

১৯৮২ সালে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে — ফোকল্যান্ড যুদ্ধ। আর্জেন্টিনা ফোকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে এবং থ্যাচার মুক্তির জন্য সামরিক বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সাফল্যের এই অভিযান তাঁকে শক্তিশালী নেতা হিসেবে মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে তাঁর দলের জন্য জয় নিশ্চিত করে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, থ্যাচার মুক্ত বাজার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণাগুলি প্রচার করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন, ১৯৮০-র দশকে 'সংরক্ষণবাদী বিপ্লবের' একজন প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। তিনি ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংবদ্ধতা গঠন করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্বাচোভের সংস্কৃতি সমর্থন করেন।

অবক্ষয় এবং পদত্যাগ

প্রাথমিক সাফল্যের পর, ১৯৮০-র দশকের দ্বিতীয়ার্ধে থ্যাচারের জনপ্রিয়তা পতনের দিকে যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারগুলো বেকারত্ব এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়। ১৯৮৯ সালে তাঁর সরকার নির্বাচকদের মধ্যে বাড়তে থাকা অসন্তোষের সম্মুখীন হয়, এবং দলের মধ্যে তাঁর সমর্থন দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৯৯০ সালে থ্যাচার তৃতীয় বার নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে পার্টির তাঁর প্রতিপক্ষরা শক্তি অর্জন করতে শুরু করেন। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অসন্তোষের ফলে, তিনি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং নভেম্বর ১৯৯০ সালে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে পদত্যাগ করেন।

রাজনীতির পর

রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর থ্যাচার বারোনেসের পদ লাভ করেন এবং সক্রিয় সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। তিনি স্মৃতিচারণ লিখতে, আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা দিতে এবং দাতব্য প্রকল্পে অংশ নিতে থাকেন। তাঁর বইগুলি, যেমন 'আত্মবিশ্বাস' এবং 'শক্তির পথে', বেস্টসেলার হয়ে ওঠে এবং তাঁর জীবন এবং কর্মজীবনের ওপর একটি অনন্য দৃষ্টি প্রদান করে।

মার্গারেট থ্যাচার বহু প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এবং নাটকীয় দেশনীতির বিষয়েও পরিণত হন। তাঁর ঐতিহ্য এখনও বিতর্কের জন্ম দেয়, তবে ব্রিটিশ এবং বিশ্ব রাজনীতির ওপর তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করা কঠিন। তিনি প্রথম নারী, যিনি এত উঁচু পদে আসীন হন এবং তাঁর অর্জন অনেক নারীকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছে।

ব্যক্তিগত জীবন

মার্গারেট থ্যাচারের ১৯৫১ সাল থেকে ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ডেনিস থ্যাচারের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে: ক্যারোলিনা এবং মার্ক। তিনি তাঁর স্বামী এবং পরিবারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, রাজনৈতিক জীবনের জটিল অবস্থার সত্ত্বেও। ২০১৩ সালে, আলঝেইমারের রোগের দীর্ঘ সংগ্রামের পর, থ্যাচার ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।

উপসংহার

মার্গারেট থ্যাচার হলেন রাজনৈতিক শক্তি এবং দৃঢ়তার প্রতীক। তাঁর অর্জন এবং দেশ পরিচালনার পদ্ধতি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছে এবং বিশ্ব রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। তাঁর ঐতিহ্য, যদিও বিরোধপূর্ণ, তা এখনও আলোচনা করা হয় এবং মানুষকে রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে।

শেয়ার করতে:

Facebook Twitter LinkedIn WhatsApp Telegram Reddit email