ঐতিহাসিক এনসাইক্লোপিডিয়া

মােঠা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র (১৯৩৯-১৯৪৫)

প্রভাবে

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, যা ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে বিশ্বকে আঘাত করেছিল, এটি মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এবং ট্র্যাজেডি সংকটগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪১ সালে পের্ল হার্বারে হামলার পর যুদ্ধে প্রবেশ করে, কিন্তু তাদের যুদ্ধের অংশগ্রহণের শুরু হয়েছিল অফিসিয়াল যুদ্ধে প্রবেশের অনেক আগে। যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের ফলে মিত্রদের বিজয় লাভের জন্য একটি মূল ভূমিকা পালন করেছিল এবং যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করেছিল।

নিষ্ক্রিয়তার নীতি

যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয়তার নীতি বজায় রেখেছিল। অনেক আমেরিকান ইউরোপীয় সংকটগুলিতে অংশগ্রহণ করতে চায়নি, এবং কংগ্রেস যুদ্ধরত দেশগুলিতে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধকরণে আইন পাস করেছিল। তবে, নাৎসি জার্মানি ও সাম্রাজ্যবাদী জাপানের আক্রমণের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ব্রিটেন এবং অন্যান্য মিত্রদের সাহায্য করার উপায় খুঁজতে শুরু করেন, যাতে তারা ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামে সমর্থন পেতে পারে।

ল্যান্ড-লিজ কর্মমালা

১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ল্যান্ড-লিজ আইন পাস করে, যা মিত্র দেশগুলিকে যুদ্ধের অংশগ্রহণ ছাড়া সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করতে সক্ষম করে। এই কর্মসূচীতে ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য মিত্রদের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ল্যান্ড-লিজ সামরিক দেশগুলির প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাদের নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামর্থ্য প্রদান করে।

পের্ল হার্বারে হামলা

৭ ডিসেম্বর ১৯৪১, জাপানি বাহিনী হাওয়াইয়ের পের্ল হার্বার মার্কিন নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই অপ্রত্যাশিত হামলায় ২৪০০ এরও বেশি আমেরিকান মারা যায় এবং অনেক যুদ্ধজাহাজ ও বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। পরদিন, ৮ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং দ্রুত জার্মানি ও ইতালি, যারা ত্রিত্ব প্যাক্টের অংশ ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার সমাপ্তি ঘটালো এবং দেশটিকে ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দুইসামনের যুদ্ধের অবস্থায় নিয়ে গেল।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলীয় সামরিক কার্যক্রম

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম চালায়, যা তাদের সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের চেষ্টা করছিল। আমেরিকানদের প্রথম বৃহত্তম বিজয়ের মধ্যে একটি ছিল ১৯৪২ সালের জুনে মিডওয়ের যুদ্ধ, যেখানে জাপানি নৌবাহিনী উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখে পড়ে। এই যুদ্ধ একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে, যার পর আমেরিকানরা জাপানের অবস্থানে আক্রমণ শুরু করে।

"দ্বীপের ঝাঁপ" অভিযান ছিল একটি কৌশল, যা যুক্তরাষ্ট্রকে মূল জাপানি দ্বীপগুলি দখল করার সুযোগ দেয়, জাপানি সীমানার দিকে এগিয়ে যেতে। গুডালকানাল, ইওয়াজিমা এবং ওকিনাওয়ার মতো কঠোর যুদ্ধে উভয় পক্ষের স্থিতিস্থাপকতা এবং সংকল্পের প্রমাণ দেখিয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত আমেরিকান বাহিনী বিজয়ী হয়, জাপানে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করে।

ইউরোপে সামরিক কার্যক্রম

ইউরোপে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অ্যান্টি-হিটলারের জোটের সদস্য হিসাবে ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দেয় যাতে নাৎসি জার্মানিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। ১৯৪৪ সালে নর্মান্ডির অবতরণ ঘটে, যা ডি-ডে হিসেবে পরিচিত, যেখানে আমেরিকান এবং ব্রিটিশ বাহিনী "ওভারলর্ড" অভিযানের সূচনা করে, যা ফ্রান্সকে নাৎসি দখল থেকে মুক্ত করে। নর্মান্ডির অবতরণ তৃতীয় রাইখের জন্য শেষের শুরু, এবং দ্রুত মিত্র বাহিনী পশ্চিম থেকে জার্মানির দিকে আক্রমণ শুরু করতে শুরু করে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব থেকে আক্রমণ করে।

যুদ্ধের পাশাপাশি, আমেরিকানরা জার্মান শহরগুলোতে আকাশ হামলার জন্য সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, অবকাঠামো ধ্বংস করে এবং জার্মান শিল্পকে দুর্বল করে। ইউরোপে মিত্র বাহিনীর অভিযান ৮ মে ১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পণের দিকে নিয়ে যায়, যা ইউরোপে বিজয়ের সূচনা করে।

পারমাণবিক বোমার ব্যবহার

ইউরোপে বিজয়ের পর, প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল, এবং জাপান আত্মসমর্পণের ইচ্ছা রাখছিল না। ১৯৪৫ সালের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নতুন অস্ত্র - পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন, যা ম্যানহাটন প্রকল্পের আওতায় তৈরি হয়েছিল। ৬ আগস্ট ১৯৪৫, পারমাণবিক বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয়, এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে। এই বোমাবর্ষণগুলির ফলে ব্যাপক ভাঙন এবং দশ হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যা জাপানকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।

যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং শিল্প অংশগ্রহণ

যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে প্রবেশ অর্থনীতির সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটায়। শিল্পকে অস্ত্র এবং সামরিক প্রযুক্তির উৎপাদনে পুনর্গঠিত করা হয়। গাড়ির কারখানাগুলি ট্যাঙ্ক, বিমান এবং গোলাবারুদ উৎপাদন করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র "গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার" হিসেবে পরিচিত হয়, মিত্রদের প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং প্রযুক্তি প্রদান করে।

যুদ্ধ সামগ্রিক সংকটের অবসান ঘটায়, যেমন কর্মসংস্থানের হার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং অর্থনীতি অতীতের যে কোনো ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের অবদান শুধুমাত্র সামরিক ছিল না, বরং অর্থনেতিক ছিল, যা তাদের বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রধান উৎপাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

পরিণতি এবং পরবর্তীতে বিশ্বের প্রভাব

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিজয় যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দুইটি সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি যেমন জাতিসংঘ, আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংক গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা তাদের বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যুদ্ধ আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনা করে, যা পরবর্তী কয়েক দশকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করে।

আমেরিকান সমাজের উপর প্রভাব

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তন এনেছে। সামরিক কার্যক্রম নারীদের শিল্পে ভূমিকার বৃদ্ধি করেছে, যেহেতু অনেক পুরুষ যুদ্ধে গিয়েছিল, এবং নারীরা তাদের চাকরির স্থান অধিকার করে। আফ্রো-আমেরিকনরাও সামরিক এবং শ্রমবাজারের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার সংগ্রামের সূচনা করে।

যুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন সমাজ আরও সংহত হয়ে ওঠে, তাদের শক্তি ও বিশ্বে ভূমিকা বুঝতে পেরে। অর্থনৈতিক উত্থান ঘটে, যা অনেক আমেরিকানের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং তাদের ভবিষ্যতের প্রতি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

সংশোধন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ যুদ্ধের ফলাফল এবং পরবর্তীতে বিশ্ব ব্যবস্থার গঠনেও বিশাল গুরুত্ব থাকতে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ এবং এশিয়াকে ফ্যাসিজম এবং সামরিকতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করেছে, যা তাদের পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী দেশ করে তোলে। যুদ্ধ আমেরিকান সমাজ এবং অর্থনীতির উপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের ভিত্তি তৈরি করেছে।

শেয়ার করতে:

Facebook Twitter LinkedIn WhatsApp Telegram Reddit email

অন্য নিবন্ধগুলি: