বিশ শতক ক্রোয়েশিয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের যুগ ছিল, যা দুটি বিশ্বযুদ্ধ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বারা চিহ্নিত হয়। এই সময়কাল দেশের সমাজ, সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীর রূপান্তরের সূচনা করে, যা আধুনিক ক্রোয়েশিয়ার চেহারা গড়ে তুলে।
বিশ শতকের শুরুতে ক্রোয়েশিয়া সার্ব, ক্রোয়াট এবং স্লোভেনিয়ার রাজ্য-এর অংশ ছিল, যা ১৯১৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির পতনের পরে গঠন হয়েছিল। এই নতুন রাজনৈতিক সংস্থা অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভুগছিল, যার মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষ এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ক্রোয়াট সংস্কৃতি এবং ভাষা সার্বীয় কেন্দ্রীয় সরকারের চাপের সম্মুখীন হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) ক্রোয়েশিয়ায় বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছিল। অনেক ক্রোয়াট সেনাবাহিনীতে ডাক পড়েছিল, এবং তাদের অনেকেই যুদ্ধের মাঠে নিহত হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যুদ্ধের পর ক্রোয়েশিয়া নতুন রাষ্ট্রের অংশ হয়ে ওঠে, কিন্তু many ক্রোয়াট তাদের অধিকার হরণ হওয়ার অনুভূতি পেতে শুরু করে, যা ভবিষ্যতের সংঘাতগুলোকে পূর্বাভাস দিয়েছিল।
১৯২৯ সালে, রাজনৈতিক সংকটের চাপের মধ্যে নতুন রাজ্য "যুগোস্লাভিয়া" নামে পরিচিত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা কঠোর কেন্দ্রীকৃত ছিল, যা ক্রোয়াট জনগণের অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বায়ত্তশাসনের জন্য একটি আন্দোলন বেড়ে ওঠে, যা ১৯৩০-এর দশকে আরো সক্রিয় হয়। ক্রোয়াট জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিকরা জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেন, এবং কেন্দ্রীয়ের সঙ্গে সংঘর্ষ কেবল বৃদ্ধি পায়।
দেশের অর্থনীতি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে ১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। বেকারত্ব এবং দারিদ্রতা বাড়তে থাকে, যা সামাজিক অস্থিরতাকে বৃদ্ধি করে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠন হতে শুরু করে, যারা পরিস্থিতির সমাধানের পথ খুঁজছিল এবং জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য সংগ্রাম করছিল।
১৯৪১ সালে, নাৎসি জার্মানির যুগোস্লাভিয়ায় আগ্রাসনের পরে, ক্রোয়েশিয়া উস্টাশা ফ্যাসিস্ট শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এটি ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়গুলোর একটি ছিল। উস্টাশা শাসন জাতিগত নির্মূলের নীতি গ্রহণ করে, যা সর্বোমোট হত্যা এবং সার্বীয় জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা, পাশাপাশি ইহুদী এবং রোমাদের প্রতি নিপীড়নের দিকে নিয়ে যায়। এই শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত হয়, যাকে নেতৃত্ব দেন পার্টিজানরা যার নেতৃত্বে ছিলেন ইয়োসিপ ব্রোজা টিটো, যা নতুন সহিংসতার ঢেউ কলঙ্কিত করে।
পার্টিজান আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুক্তির জন্য আগ্রহী জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দ্বারা সমর্থিত হয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ होने পর টিটো এবং তার সহযোগীরা বিজয়ী হন এবং ক্রোয়েশিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেটিভ গণতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়ার অংশ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রোয়েশিয়া, যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের বছর কাটায়। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শিল্পজাতকরণের পাশাপাশি ভূমি সংস্কারের দিকে নিয়ে যায়। দেশটি সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার অধীনে বিকাশিত হতে শুরু করে, এবং ক্রোয়েশিয়ায় নতুন কারখানা, অবকাঠামো এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
যদিও টিটো শাসনও বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের বিকাশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। ক্রোয়েশিয়া, উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধারণ করে, সম্পদের বিতরণের ক্ষেত্রে অসন্তোষ অনুভব করতে শুরু করে। এই সময় জাতীয়তাবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা কেন্দ্র ও প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে বিরোধ তৈরি করে।
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে, টিটোর মৃত্যুর পর, যুগোস্লাভিয়া অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়। ক্রোয়াট জাতীয়তাবাদীরা শক্তি অর্জন করতে শুরু করেন এবং তাদের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি সাধারণ অস্থিতিশীলতার মধ্যে শুনতে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে ক্রোয়েশিয়ায় প্রথম মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ফ্রাঞ্জো তুজমানের নেতৃত্বে ক্রোয়াট গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন বিজয়ী হয়। এই মুহূর্তটি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যা যুগোস্লাভিয়ান পিপলস আর্মির সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করে। শুরু হয় ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ, যা ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সংঘর্ষের ফলে তীব্র যুদ্ধ, গণ স্থানান্তর এবং জাতিগত নির্মূল ঘটে, বিশেষ করে সার্বদের প্রাচীন অঞ্চলগুলিতে। যুদ্ধ ক্রোয়াট বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে শেষ হয় এবং ডেটন চুক্তির স্বাক্ষরের মাধ্যমে, যা অঞ্চলটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।
যুদ্ধের পর ক্রোয়েশিয়া বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং জাতিগত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এই সময় ব্যাপক পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক সংস্কার প্রোগ্রাম শুরু হয়। ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোতে সংহতির পথে পা বাড়ায়, যা দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
২০০০-এর দশকে ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয়তা পূরণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সংস্কারের দিকে কাজ শুরু করে। ২০০১ সালে ক্রোয়েশিয়া স্থিতিশীলতা এবং সহযোগিতা চুক্তিতে (stabilizaciji i pridruživanja) স্বাক্ষর করে, যা ইউরোপীয় সংহতির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। ২০১৩ সালে ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়ে ওঠে, যা ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
বিশ শতক ক্রোয়েশিয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অর্জনের সময় ছিল। ক্রোয়াট সাহিত্য, শিল্প এবং সঙ্গীত অব্যাহতভাবে বিকাশ করছে, যা সমাজের পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। অনেক ক্রোয়াট লেখক, যেমন মিলোরাড পাভিচ এবং ইভান ক্রেশিমির, আন্তর্জাতিকদৃষ্টিতে পরিচিত হয়ে ওঠেন। প্রতিভাবান শিল্পী এবং স্থাপত্যবিদদের জন্য ক্রোয়াট শিল্পও স্বীকৃতি পেয়েছে।
আধুনিক ক্রোয়েশিয়া এখনও এক বিশেষ পরিচয় রক্ষা করতে চায়, ইউরোপীয় সমাজে সংহতিত্ব বজায় রাখতে। পর্যটন দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, এবং ক্রোয়েশিয়া তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
বিশ শতকে ক্রোয়েশিয়া বহু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা তার বর্তমান সমাজকে গঠিত করেছে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সংহতির পথে, এই সময়কাল দেশের পরিচয় গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে এসেছে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং সাংস্কৃতিক অর্জনগুলি XXI শতকে ক্রোয়েশিয়ার সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।