ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন ইহুদি জাতির ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই প্রক্রিয়াটি অনেক ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে আবৃত, যা ১৪ মে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আসে। এই প্রবন্ধে, আমরা ইসরাইল গঠনের বিভিন্ন পর্যায় এবং মুখ্য ঘটনাগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠনের ঐতিহাসিক শিকড় তারা প্রাচীন সময়ে ফিরে যায়, যখন ইহুদিরা আধুনিক ইসরাইলের ভূখণ্ডে বসবাস করত। যদিও, নির্বাসন, বিরোধীতামূলক আচরণ এবং যুদ্ধের ফলস্বরূপ, ইহুদি জাতি পুরো পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উনিশ শতকে সিয়নিস্ট আন্দোলন উঠেছিল, যা ইহুদিদের তাদের ঐতিহাসিক মাতৃভূমিতে ফিরে আসা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য চেষ্টা করছিল।
সিয়নিজম, যা ইহুদিদের জন্য জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণার উপর ভিত্তি করে গঠিত, প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসনের বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে, বিশেষ করে ১৯১৭ সালের বালফুর ঘোষণা প্রকাশের পর, যেখানে ব্রিটেন এই এলাকায় একটি ইহুদি জাতীয় বাড়ির সৃষ্টি সমর্থন করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন প্যালেস্টাইন ব্রিটেনের ম্যান্ডেট অঞ্চল হয়ে ওঠে, ইহুদি সম্প্রদায়গুলি অর্থনীতি, শিক্ষা এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে মনোনিবেশ করতে শুরু করে।
২৮ নভেম্বর ১৯১৭ সালে প্রকাশিত বালফুর ঘোষণা সিয়নিজম এবং ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে একটি মূল মুহূর্ত হয়। এই নথিত ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্টাইনে "ইহুদি জাতীয় বাড়ির" সৃষ্টি সমর্থন করার কথা জানায়, যা ইহুদি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়। তবে এই ঘোষণা অঞ্চলের আরব জনসাধারণের উদ্বেগের সৃষ্টি করে, যারা তাদের অধিকার এবং ভূমি হারানোর ভয় পেয়েছিল।
যুদ্ধের পর, লীগ অফ নেশনস প্যালেস্টাইন পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকে অনুমোদন করে, অর্থাৎ ব্রিটেনকে ইহুদি অভিবাসন এবং ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নয়ন সমর্থন করতে হবে। ফলস্বরূপ, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, যা ইহুদি সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করে, তবে এটি ইহুদি এবং আরব জনসাধারণের মধ্যে চাপ আরও বাড়িয়ে তোলে।
১৯২০-এর দশকের শুরু থেকে প্যালেস্টাইনে ইহুদি এবং আরব সম্প্রদায়গুলির মধ্যে চাপ বাড়তে শুরু করে। আরবরা ইহুদি অভিবাসনের বৃদ্ধি এবং ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ছিল, যা সংঘর্ষ এবং সহিংসতার দিকে নিয়ে যায়। এই বিরোধ ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের আরব বিদ্রোহের সময় তীব্র হয়ে ওঠে, যখন আরব জাতীয়তাবাদীরা ইহুদি অভিবাসন বন্ধ করার এবং একটি আরব রাষ্ট্র তৈরির দাবি করছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্ট, যা ইহুদি জাতির জন্য একটি বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায়, ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে তোলে। বৈশ্বিক সম্প্রদায় ইহুদিদের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, যা সিয়নিস্ট ধারণাগুলির সমর্থন বাড়ানোর দিকে পরিচালিত করে। ১৯৪৭ সালে, জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভা প্যালেস্টাইনকে ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করার একটি প্রস্তাব গৃহীত করে, যা ইসরাইলের গঠনের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়।
২৯ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভা প্রস্তাব ১৮১ গ্রহণ করে, যা দুইটি রাষ্ট্র — ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে, সঙ্গে জেরুজালের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। প্রস্তাবটি বেশিরভাগ ভোটে গৃহীত হয়, তবে আরব দেশগুলি এটি প্রত্যাখ্যান করে, যা দ্বন্দ্বের অগ্রগতি ঘটায়। তবে তাত্ত্বিক ইহুদি নেতারা, ডেভিড বেন-গুরিয়ন সহ, বিভাজনের পরিকল্পনায় সমর্থন করে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে এটি একটি পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
জাতিসংঘের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর, প্যালেস্টাইনে ইহুদি সম্প্রদায় রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। ইহুদি প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন গঠিত হয়। এ সময় ইউরোপ থেকে ইহুদিদের অভিবাসনও বাড়ে, যারা অনেকেই হলোকাস্ট পরবর্তীকালে আশ্রয় চেয়েছিল।
১৪ মে ১৯৪৮ সালে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সমাপ্তির প্রাক্কালে, ডেভিড বেন-গুরিয়ন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী, বেন-গুরিয়ন বলেন, "ইসরাইলের রাষ্ট্র বিশ্বের সমস্ত ইহুদি অভিবাসীদের জন্য খোলা থাকবে" এবং "সেখানে সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা হবে"। স্বাধীনতার ঘোষণা ইহুদি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে উৎসাহের সঙ্গে গৃহীত হয়, কিন্তু এটি আরবি দেশগুলির পক্ষ থেকে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ইসরাইলের স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়, যখন প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলি, যার মধ্যে মিসর, জর্ডান এবং সিরিয়া অন্তর্ভুক্ত ছিল, নতুন ইহুদি দেশে আক্রমণ করে। সংঘর্ষ উভয় পক্ষের জন্য গুরুতর ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়, কিন্তু অবশেষে ইসরাইল নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার সক্ষম হয় এবং যুদ্ধের ফলে তাদের এলাকা সম্প্রসারণ করে।
ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্ব ব্যবস্থার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। ইহুদি জাতির জন্য, এটি জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ইহুদি সংস্কৃতি ও ভাষার পুনর্জাগরণের বাস্তবায়ন হয়। তবে প্যালেস্টাইন এবং প্রতিবেশী দেশের আরব জনসাধারণের জন্য, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সূচনা ছিল, যা আজও চলমান।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর অনেক প্যালেস্টাইন শরণার্থী হয়ে পড়েছিল, যা মানবিক সংকট এবং সংঘাতের বৃদ্ধি করে। প্যালেস্টাইন শরণার্থীদের সমস্যা ইসরাইল-আরব সংঘাতে একটি জটিল এবং যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হিসেবে বিদ্যমান, যা সকল পক্ষের অধিকার এবং চাহিদার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা 요구 করে।
ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন ইহুদি জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা তাদের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে নিশ্চিত করে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এবং ইসরাইল ও আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সম্পর্কের দিকেও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে রয়ে গেছে। জটিলতা এবং বিরোধ থাকা সত্ত্বেও, ইসরাইল ইহুদি জীবন এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের আকৃষ্ট করে।
ইসরাইলের রাষ্ট্র গঠন একটি আশা, সংগ্রাম এবং আত্মনির্ভরতার গল্প। এই প্রক্রিয়া ইহুদি জাতির জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বহু বছরের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ। চলমান সংঘাত এবং চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, ইসরাইল লক্ষ লক্ষ ইহুদির জন্য পুনর্জাগরণের এবং নতুন জীবনের প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।