ইরাক — একটি সমৃদ্ধ এবং বহুস্তরীয় সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সহ দেশ, যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে মহান ব্যক্তিত্বগুলি বাস করে এসেছে এবং ইতিহাসে অচলিণী ছাপ ফেলেছে। প্রাচীন শুমেরীয় রাজা ও চিন্তাবিদ থেকে আধুনিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে, ইরাক বিশ্বকে অনেক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে, যারা সভ্যতা, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং রাজনীতির বিকাশে প্রভাব ফেলেছে। এই নিবন্ধে আমরা ইরাকের কিছু সর্বাধিক পরিচিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বগুলির উপর আলোচনা করবো, যাদের কাজ এবং উত্তরাধিকার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছে।
প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলো গিলগামেশ — উরুক শহরের কিংবদন্তী রাজা, যিনি আনুমানিক 2600 খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাস করতেন। তার নাম বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্যকর্মগুলির মধ্যে একটি — "গিলগামেশের মহাকাব্য" এর সঙ্গে জড়িত। পৌরাণিক কাহিনীগুলির অনুযায়ী, গিলগামেশ আধা দেবতা, আধা মানুষ ছিলেন, যিনি অসংখ্য শক্তি এবং অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার জন্য পরিচিত। মহাকাব্যটি তার বিভিন্ন অভিযানের এবং জীবনের অর্থ অনুসন্ধানে, বন্ধুত্বের সঙ্গে এনকিডুর, দেবতাদের এবং দানবদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ও অমরত্বের অনুসন্ধানের কাহিনী বর্ণনা করে। গিলগামেশের পৌরাণিক কাহিনী কেবল ইরাকের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে এবং আজও প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীগুলি অধ্যয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
হামুরাবি, যিনি ১৮ শতকের পূর্বে বাভিলন রাজ্য শাসন করেছিলেন, প্রাচীন ইরাকের ইতিহাসের সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রভাবশালী রাজাদের মধ্যে একজন। তিনি তার আইনসম্মত সংস্কার এবং "হামুরাবির আইনসভা" তৈরির জন্য পরিচিত — যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং সর্বাধিক সম্পূর্ণ আইনের সংকলন। এই আইনসভায় বাভিলনের জীবনের সমস্ত দিক নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ম এবং আইন অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন বাণিজ্য এবং বিবাহ থেকে অপরাধের জন্য শাস্তি। হামুরাবির আইনসম্মত শাসন ফরিয়াদ ও আইনে সমানতার নীতিগুলি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা পরবর্তী সভ্যতায় আইনের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। হামুরাবি বাভিলনকে শক্তিশালী করে এবং এটিকে তার সময়ের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী শহর বানিয়েছিলেন।
আশুরবানাপাল (৬৬৮–৬২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) — অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শেষ মহান রাজা, যিনি তার সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের জন্য পরিচিত। তিনি একজন আলোকিত শাসক ছিলেন, যিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্পে আগ্রহী ছিলেন। আশুরবানাপাল নিনেভিয়ায় একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন, যা হাজার হাজার চুক্তিতে লেখা টেক্সট সমন্বিত ছিল বিভিন্ন ভাষায়। তার প্রচেষ্টার কারণে "গিলগামেশের মহাকাব্য" এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থগুলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা পেয়েছিল। তিনি একজন সামরিক নেতা হিসেবেও পরিচিত, যিনি অ্যাসিরিয়ার শত্রুদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে এর অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিলেন। সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আশুরবানাপালের উত্তরাধিকার আজও বজায় আছে।
আল-কিন্দি (৮০১–৮৭৩) — একজন বিশিষ্ট আরব দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী, যাকে প্রায়শ "আরব দার্শনিকতার পিতা" বলে উল্লেখ করা হয়। কুফায় জন্মগ্রহণকারী, তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা এবং দার্শনিকতায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। আল-কিন্দি প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের কাজগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করার প্রথম অনুবাদকদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং ইসলামিক বিশ্বে প্রাচীন জ্ঞানের প্রাথমিক স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি যৌক্তিকতা, মেটাফিজিক্স এবং নৈতিকতা নিয়ে তার কাজের জন্যও পরিচিত, যা মধ্যযুগে বিজ্ঞানের এবং দার্শনিকতার বিকাশে প্রভাব ফেলেছে।
আল-মুতাওয়াক্কিল (৮২২–৮৬১) ছিলেন আববাসীয় খলিফা, যিনি তার সংস্কার এবং বিজ্ঞান ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পরিচিত। তার সময়ে বাগদাদ ইসলামিক বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, যা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদদের আকর্ষণ করেছিল। আল-মুতাওয়াক্কিল অনেক বিদ্যালয় এবং গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিজ্ঞান গবেষণাকে সহায়তা করেছিলেন এবং চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং দার্শনিকতার বিকাশে উৎসাহিত করেছিলেন। তার শাসন ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
সদ্দাম হোসেন (১৯৩৭–২০০৬) — ইরাকের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত নেতা। তিনি ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তার কঠোর রাজনৈতিক নীতি এবং নির্বাহী শাসনের জন্য পরিচিত। তার শাসনকালে ইরাক একাধিক যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিল, যেমন ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০–১৯৮৮) এবং পারস্য উপসাগর যুদ্ধ (১৯৯০–১৯৯১)। সদ্দাম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতি ব্যবহার করেছিলেন, যেমন কুর্দিরা এবং শিয়া মুসলিম। ২০০৩ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনীর আক্রমণের পর সদ্দামের সরকার উল্টে যায় এবং তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীতে ফাঁসির শিকার হন। তার শাসন ইরাকের ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছিল এবং অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলেছিল।
নাজি আল-আলি (১৯৩৭–১৯৮৭) — একজন বিশিষ্ট ইরাকী শিল্পী এবং কারিকুরিস্ট, যিনি তাদের কাজের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন। তিনি তার চরিত্র হান্দালের জন্য পরিচিত — একটি নগ্ন পা বিশিষ্ট ছেলে, যা আরব জনগণের দারিদ্র্য এবং যন্ত্রণার প্রতীক। আল-আলির কারিকুরিগুলি কেবল ব্যঙ্গাত্মক নয়, বরং গভীর দার্শনিকও ছিল এবং তিনি ন্যায় এবং বাকস্বাধীনতার জন্য লড়াই করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন। তার সৃষ্টিকর্ম আরব সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল, এবং তিনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক শিল্পের একটি আইকন হিসেবে অব্যাহত রয়েছেন।
ফাদেল আল-জামালি (১৯০৩–১৯৯৭) — একজন পরিচিত ইরাকী রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং বিজ্ঞানী, যিনি আধুনিক ইরাকী রাজনীতি এবং শিক্ষার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, আন্তর্জাতিক ফোরামে ইরাকের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আল-জামালি আরব ঐক্য এবং ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির থেকে স্বাধীনতার স্বপক্ষে ছিলেন। তার কার্যক্রম ২০ শতকের মাঝামাঝি ইরাকী রাষ্ট্রত্বকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হয়েছে।
ইরাক বিশ্বকে অনেক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে, যারা বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং শিল্পের বিকাশে প্রভাব ফেলেছে। এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বগুলি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছেন এবং ইরাকের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রাচীন রাজা এবং দার্শনিক থেকে আধুনিক নেতা এবং শিল্পীদের মাধ্যমে, তাদের অর্জনগুলি নতুন প্রজন্মের ইরাকী এবং বিশ্বের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে।